Monday, August 31, 2015
তুষ্টি ভট্টাচার্যঃ আশা করছি
আপনার নতুন কবিতার বইয়ের প্রকাশক প্রস্তুত হচ্ছেন। আপনি জানিয়েছেন, আমাদের রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীমূলক বইটির
ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চের কাজ করেছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা আমাদের
সাথে ভাগ করে নেবেন? অনুবাদের বই দুটি সম্বন্ধেও যদি কিছু বলেন...
অগ্নি রায়ঃ এই
কাজটি মূলত অবজেক্টিভ রিসার্চের কাজ। এখানে মনের রসদ যে খুব একটা পাওয়া গিয়েছে
এমনটা নয়। লাইব্রেরি ঘেঁটে ইন্দিরা গাঁধীর সময়কার রাজনৈতিক চাপানউতোর, রাজধানীর
রাজনীতি, জরুরি অবস্থা, বাংলা কংগ্রেসের উত্থান এবং পতনের ইতিহাস -- যখন যে রকম
প্রয়োজন হয়েছে জোগাড় করা হয়েছে। পার্লামেন্ট প্রসিডিংস বা চিঠির মধ্যে লুকিয়ে
থাকা নথি সংগ্রহ। এই ধরণের ব্যাপার আর কি। তবে হ্যাঁ কাছ থেকে দেখেছি প্রণব
মুখোপাধ্যায়ের প্রবাদপ্রতিম স্মৃতিশক্তি। এটা একটা অভিজ্ঞতা তো বটেই। উনি মুখে
মুখে শুধু দেশের নয়, বিশ্বের ইতিহাস বলে যেতে পারেন সন-তারিখ সহ। এই ব্যাপারটা
খুবই দুর্লভ।
তুষ্টিঃ আপনার প্রিয় বই, প্রিয় লেখক সম্বন্ধে কিছু বলুন।
অগ্নি রায়ঃ স্বর্গ কীরকম দেখতে বলে আপনার ধারণা? এই প্রশ্নের
উত্তরে হর্হে লুই বর্হেস বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই অনেকটা লাইব্রেরির মতন!’
প্রিয় বই বা লেখকের
বৃত্তান্ত বলতে বসলে তো ভোর হয়ে যাবে। একজন লেখক তাঁর আয়ুর অনেকটা ঢেলে দিয়ে একটা
বই লেখেন। স্বাভাবিকভাবেই তা একটি সমান্তরাল আয়ুর জন্ম দেয়। আমরা যেমন একদিকে
দশটা-পাঁচটা, ই এম আই, বকেয়া বিল, মিটিং পর্যটন, মাসকাবারি, এলআইসি, ডিভোর্স,
মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির মধ্যে বাঁচি--- তেমনই বইয়ের মধ্যেও তো বাঁচি জীবনের
অনেকখানিই। প্রত্যন্ত কোনও লাইব্রেরির অন্ধকার কোণার আলমারির অমুক তাকের, তমুক
বইয়ের কোনও পাতায় হয়তো আমার একটুখানি খুব গোপনে লেগে রয়েছে।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার
বলেছিলেন যে বন্যা মন্বন্তর বা মহামারিতে যদি বাংলার গ্রাম ধ্বংসও হয়ে যায় তবে
তারাশঙ্করের লেখা ধরে ধরে আবার সেই গ্রাম সভ্যতা পুর্ননির্মান করা যেতে পারে!
অসামান্য লাইন, তাই না?
তো আমারও মনে হয়, মানে আমি
ভাবতে ভালবাসি যেযখন থাকব না, তখন যদি কোনও বন্ধু আমায় খুঁজতে চান, তবে সারাজীবন
আমি কী পড়লাম তার মধ্যেই খুঁজে পাবেন। এটা বোধহয় অনেকের ক্ষেত্রেই সত্যি –তাই না?
রোলা বার্থ-এর ‘ডেথ অব দ্য অথর’ অনুযায়ী লেখার পর সেই টেক্সট থেকে লেখক মানে মানে
কেটে পড়েন। তার উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকানা শুধু কাছের দূরের পাঠকের। পাঠক নিজে
অবনির্মান করে সেই টেক্সট। নতুন করে তৈরিও করে। অবশ্যই সেখানে বয়স রেখা একটা বড়
ব্যাপার। মানে, বলতে চাইছি, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে
আকাশে’–র যে মুগ্ধতা আমার শৈশবে ছিল, আজও পড়লে কিছু সারপ্লাস মিনিং হয়তো পাওয়া
যায়, কিন্তু সেই শৈশব আচ্ছন্নতা তো আর নেই। থাকার কথাও নয়।
বাংলা মি়ডিয়ামে প়়ড়াশুনো
করেছি, তাই ছোটবেলায় বিশ্বসাহিত্য আমার কাছে এসেছে মূলত অনুবাদে। দেবসাহিত্য
কুটিরের সেই অনবদ্য সিরিজ! ভিতরে সেপিয়া কালারের ব্লক ছবি। কি নেই সেখানে? সলোমনের
ঐশ্বর্য্, স্যামসনের পৌরুষ, লিটল উইনেমদের খুনসুটি, জুলে ভার্নের তাক লাগানো
সায়েন্স ফিকশন, জ্যাকেল হাইডের বৈপরীত্য, মন্টে ক্রিস্টোর কাউন্ট হয়ে এডমন্ট
দান্তের ফিরে আসা--- আরও কত কি। পাশাপাশি রাজর্ষির-‘এত রক্ত কেন?’ কথা ও কাহিনী,
শিশু, হযবরল। নারায়ন দেবনাথের বিশ্বমানের কাজ আমরা ছোটবেলায় পেয়েছি নিজেকে ভাগ্যবান মনে
করি। অরণ্যদেব ম্যানড্রেকের পাশাপাশি। সে সময় বিদেশে কেউ গেলে ব্যাটম্যান
সুপারম্যান (‘ফাস্টার দ্যান লোকোমোটিভ’—এ হেন বিশেষণ সুপারম্যান সম্পর্কে পড়ার পর
আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল মনে আছে)
নিয়ে আসতেন, এখানে সে সব পাওয়া যেত না। এবং অবশ্যই টিনটিন।
খুব অল্পবয়সেই (ক্লাস সিক্স,
সেভেন) ইঁচড়ের মত পাকতে আমাকে যে মহাগ্রন্থগুলি সাহায্য করেছিল সেগুলির উল্লেখ না
করলে অন্যায় হবে। তারমধ্যে যেমন একদিকে ছিল পাড়ার লাইব্রেরিতে সোনার জল দিয়ে
নামাঙ্কন করা বিশ্বের নিষিদ্ধ উপন্যাস সিরিজ (ট্রপিক অব ক্যান্সার, লেডি
চ্যাটার্লি সমৃদ্ধ), অন্যদিকে কাকুর বিয়েতে উপহার পাওয়া সমরেশ বসুর ‘আরব সাগরের জল
লোনা’ (প্রজাপতি, বিবরের পর লেখা) উপন্যাসটি। মঁপাসার ছোটগল্পের অনুবাদ। এছাড়া
অধুনা বিস্মৃত অনেক বই এবং লেখক আছেন, তাঁদের ‘অ্যাডাল্ট’ উপন্যাসগুলি এখন আর মনে
পড়ছে না। এছাড়া স্বপনকুমারের চটিবইগুলি তো ছিলই, যার প্রথম পাতায় লেখা
থাকতো‘কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’! ফলে স্কুল ছাত্রের কাছে তার আকর্ষণ ছিল
বহুস্তরীয়!
তবে এই বিবিধ পাঠ অভিজ্ঞতার
ফলে আখেরে যা হল, তা অক্ষরের প্রতি এক দুর্মর টান। যা পরকীয়ার টানের থেকে কিছু কম
নয়! মুড়ির ঠোঙা পেলেও না পড়ে ফেলে দিয়েছি মনে পড়ে না।
পরবর্তীকালে এবং এখনও
পর্যন্ত যাঁদের কবিতা আমাকে আক্ষরিক অর্থে ধরে রেখেছে তার মধ্যে অবশ্যই শক্তি
চট্টোপাধ্যায় এবং উতপল কুমার বসু অগ্রগণ্য। জীবনানন্দের কাছে বারবার বিভিন্ন শক
এবং অ্যাক্সিডেন্টের পরে যেতে হয়েছে আরও ছ্যাঁকা খেতে হবে তা জেনেও। নিরূপায় ভাবে
জীবনানন্দের কবিতা এবং গদ্যের কাছে নতজানু হয়ে রয়েছি সেই কবে থেকে। যেভাবে রবি
ঠাকুরের গানের কাছেও। বাংলা কবি এবং কবিতার বইয়ের তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই, শেষ হবে
না। অন্যদেশের কবিদের মধ্যে রিলকে, টি এসএলিয়ট, অক্টাভিও পাজ (ওঁর পিকটোরিয়াল বা
ভিস্যুয়াল ভার্স-সমেত), গিনসবার্গের গোড়ার দিকের কাজ, ডিলান থমাস, কোহেন, জিম
মরিসন, বব ডিলানের অংশভাগ, সিলভিয়াপ্লাথ, ফিলিপ লারকিন,
নিকানুর পাররা। হার্ট ক্রেনের সানডে মর্নিং অ্যাপেল খুবই প্রিয় কবিতা। সেই কবে
পড়েছিলাম ওয়াল্ট হুইটম্যানের লিভস অব গ্রাস,-- আজও সে আমাকে ছাড়েনি। সম্প্রতি
পড়ছি ডেভিড লেহম্যানের সম্পাদনায় একটি মার্কিন কবিতার সংকলন। বর্তমান শতকের
লেখালেখি নিয়ে। ব্যমকে যাওয়ার মত কাজ
হচ্ছে সেখানে। একটি কবিতা অবশ্যই আপনাকে পড়তে অনুরোধ করব (অন লাইন নিশ্চয়ই রয়েছে)
ম্যাথু ইয়েগারের ‘আ জার অব বেলুনস অর দ্য আনকুকড রাইস’।
উত্তর দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বিষয় যখন বই, তখন কিছু তো করার নেই। তাও এখানে মূলত কবিতা নিয়েই কিছু কথা
হল। ফিকশন এবং নন ফিকশন পাল্প ফিকশন খচিত যে গদ্য সাহিত্য সেই বিস্তারিত
প্রসঙ্গ আর আনলাম না, পরে কখনও সুযোগ হলে আলোচনা হবে।
তুষ্টিঃ দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সফরে আপনি সাথী হন সাংবাদিক
হিসেবে। সময়ে সময়ে দল পাল্টেছে, মন্ত্রী বদল হয়েছেন, আপনি এসব দেখেছেন খুব কাছ
থেকে। এ বিষয়ে আপনার প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে নিশ্চয়ই। সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে
আমাদের কিছু শোনান।
অগ্নিঃ সত্যি কথা বলতে কি, এই
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদেশসফর --– এগুলির একটি বাহ্যিক
আড়ম্বর এবং গ্ল্যামারের দিক আছে। ফলে মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়ার চান্স খুবই।
কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে এই গ্ল্যামার যাত্রা দলের রং মাখা রাজার মত। তিনদিন
চারদিন বিদেশে বাজপেয়ী মনমোহন মোদী রাজা উজির করে এসে মাসের শেষে আবার আপনি মাস
মাইনের কর্মী ছাড়া কিছু নন। যতক্ষণ ওই ক্ষমতার আলোর বৃত্তে রয়েছেন, সেই আলো অন্য
মহামহিমদের থেকে বিচ্ছিরিত হয়ে এসে লাগছে আপনার গায়ে। আপনি উদ্ভাসিত হচ্ছেন
রিফ্লেক্টেড গ্লোরিতে। ওই বিশেষ বিমানে ওঠার পর আপনি চাওয়ামাত্র হাজির হচ্ছে
শ্যাম্পেন ক্যাভিয়ার—কি নয়। প্রমোদতরণী থেকে বেলি ডান্সিং-এর আয়োজনও একটা সময় থাকত
(এখন কমে গিয়েছে) সরকারি অর্থে। অবশ্য এই সব হাই প্রোফাইল ভিজিটগুলিতে অনেকসময়
সাংবাদিকদের জন্য বিভিন্ন কালচারাল এক্সচেন্ঞ্জ এবং সোশ্যাল ইভেন্ট-এর আয়োজন করে
থাকেন অনাবাসী শিল্পকর্তারাও। সেখানে উপস্থিত থাকেন সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন
অনাবাসী বিভিন্ন পেশার মানুষজন।
তবে অবশ্য একজন সাংবাদিকদের
দৃষ্টিকোণে গোটা বিষয়টি অত্যন্ত এনরিচিং, একটা ভিন্ন মিলিউ তৈরি হয়, যেটা দেশের
মাটিতে রিপোর্টিং করে পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। সরকারি শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাদের অনেক
খোলামেলা মেজাজে পাওয়া যায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়। সরকারি কীভাবে
এগোতে চাইছে বা চাইছে না তার একটা দিশামুখ পাওয়া যায়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
পড়তে পড়তে শেষ হয়ে গেলো বড্ড তাড়াতাড়ি ।
ReplyDeleteআরো পড়তে চাই।
আগামী পর্বে আরও পাবেন। গত দুটি পর্ব এখান থেকেই পড়ে নিন
Delete