Monday, August 31, 2015
দেবদারু অপেরা – সমস্ত বিভ্রম খুলে শব্দের প্রিজম পৃথিবী ।
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
জয়শীলার কবিতার অক্ষর আমি চিনি সেই “
হৃদপিণ্ড শুকোতে দিয়েছি বাম অলিন্দে হলুদ ছত্রাক “ এই লাইনগুলো আজও মনে রয়ে গেছে ,আর সেই শুকনো
হৃদপিণ্ডের জন্য এক অন্য পৃথিবীর অনুসন্ধান
তাঁর চির জিজ্ঞাসু বিশ্ববীক্ষা । কবিতার সামগ্রিক বিচ্ছুরণ এবং শিকড়লগ্ন চেতনাকে গভীর ভাবে অনুভব করলাম তাঁর
প্রথম কাব্যগ্রন্থ দেবদারু অপেরায় । বস্তুত আত্মপ্রচারের বিপরীতে হেঁটে আসা এই
কবির ভাবনা ভাস্কর্য আমাকে আবিষ্ট করে কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা থেকেই – বাবা
বলত গল্প/ চড়াই পাখিটা ধানের গোলা থেকে / ঠোঁটে তুলে আনছে / এক একটা ধান / ভাত
খেতে খেতে রোজ / বাবা বলত /আমিও বলি গল্প/ মিষ্টি মেনি বেড়ালের / ওর গোঁফে চরাইএর
পালক । “ পুরো কবিতাটি আমার ঠোঁটে লেগে
থাকবে আজীবন । আয়না সরিয়ে ফটোকপি সরিয়ে
পর্দা খোলাই যায় – এই অঙ্গীকার
নিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামে তাঁর পরিব্রাজক কলম –
মাধ্যাকর্ষণে ঝুলে থাকে জন্মান্তর / সুতো ছিঁড়ে ওড়ে কি বেলুন ? /ওড়ে পুরনো ধুলো /
পরিব্রাজক আভূমি জুতো ছেড়ে যায় । (ভ্রমণ) ।
জয়শীলার
কবিতার বহুমাত্রিক বর্নময়তা যা পাঠককে নিজের মত করে ভাববার যথার্থ স্পেস দেয়। ফলে
তাঁর কবিতা পড়তে পাঠক পথ হারায় না বরং আবিস্কার করে এক নতুন দিগন্ত । পাঠক পাঠিকার
কাঁধে এভাবেই নিজের হাত রাখেন তিনি ।
শব্দনির্বাচনের মুন্সিয়ানা শুধু নয় ইঙ্গিতময় শব্দের জাদু কবিতাকে এক অপার
সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায় – এভাবেই দেখা
সম্পন্ন হল/ প্রিজমের কাটিং / কোয়ান্টামের খেলাধুলা আর আমার রাত/ ডুবতে ডুবতে
অক্সিজেন ছাড়া .../ ...... চুমু খাই দূরের তরঙ্গ জীবন/ এক পা এক পা টলোমলো হাঁটে
স্নায়ু/ বোবা আলজিভ উপহার পেয়েছি সদ্য ।(
আলজিভ ) বা কুমোরের ছাঁচ হারিয়ে গেছে, সেইসব হীরের দানা /
সমঝোতা চলে জলে স্থলে/ টাওয়ারে লটকে আছে যে বাতাস/কফিনের ওম খুঁজে খুঁজে .../
বেড়ালছানাটি ভাল থাকে ( দিন )
ভাবতে
ভাবতে ভেঙে যায় আয়না । তবু খেলা চলে । আর কবি দেখতে থাকেন শব্দের শ্বাস প্রশ্বাস তিরন্দাজী শব্দের মিছিলে
মিছিলে তৈরি হওয়া বিন্যাস। ফলে আকৃতি লাভ করে সমূহ সম্ভব ও সম্ভাবনা –
এক একটা মাসল পেরিয়ে তবে কান পাওয়া গেল। সিঁড়ি চড়তে
চরতে...... শেষ না হওয়া ...
কাঁধের কাছটায় অন্ধকারে বৃদ্ধ বসে আছে ... ( দেখা )
এভাবেই তিনি সনাক্ত করেছেন জরিপ করেছেন লঙ্ঘন করেছেন সময়ের আকস্মিকতাকে ।
অধিত অতিক্রমণের মধ্য দিয়েই সিঁড়ি ভাঙতে
ভাঙতে তৈরি হয়েছে তাঁর শব্দ স্থাপত্য – রুটি সেঁকা হলে/ জমা আঁচে / বাকি
থাকে মরচের দাগ / শ্যাওলাও ওঠেনি / জোনাকিরা কেমিক্যাল দিয়ে গেছে/ এই ই ঘর/ এই ই
বাহির/ এইসব হিমে ভেজা নার্সারি / দুই হাত ভরে থাকে / ক্যাকটাস ফুলে ।( ক্যালপল)
আধুনিকতার ধারাবাহী এক পরম্পরার মধ্যেও
নিজস্ব পথের মানচিত্র ও তরঙ্গবেগ তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই ।কবির
নির্মিত কথাবিশ্ব বহুমাত্রিকতায় ব্যপ্ত যেমন হয়েছে পাশাপাশি সময় ও পরিসরের
গ্রন্থনার বাইরেও খুঁজে পেয়েছে এক
নীলাঞ্জন আশ্রয় ।চুলের কাঁটার পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে সন্ধান করেছেন এক মৌলবিশ্ব -
১ দরজা খুলে
বিভ্রম খুলে/ শব্দ হাউই নিয়ে উড়ে যাই ( দরজা )
২ দরজা হারিয়ে
গেলে চাবি থেকে যায় ( দেখা )
৩ একটা দেশলাই
কাথি, পোড়া / ধরে নেওয়া যাক এক্স /
তারপর ...... ( থিয়োরি ও ফ্যান্টাসি )
৪ শরীর থেকে শেষমেশ ঝরে যায় ধাতব ধার / তারপর শুধু জোড়া
জোড়া চোখ ( যা থাকে )
৫ একটু একটু
করে ভিজে ওঠে সন্দেহ (কাঁটা )
৬ উচ্চারণ
বদলায় না বলে পুরনো কম্বল আজও শুয়ে ( সীমিত)
৭ দিশেহারাও মেদুর কিশোরী হয়ে ওঠে (চকমকি)
৮ পদ্মাসন ছাড়া
আর কিছু লেখা হয়না ( দাহ্য)
৯ মনোযোগ খসে
গেলে / যারা কুড়োয় তুলে নেয় / আনমনে গতি (
বিশেষণ )
১০ যেখান থেকে হাত সরিয়ে নিলেই / মাধ্যাকর্ষণ উড়ে যায় /
সেখানে রুটি রাখা হলে / রুটিও খোলস ছাড়ে ।( বস্তুগত )
এভাবেই পরিমিতি বোধে
অনুভুতির সংবদ্ধতায় দেবদারু অপেরা
কবিতার এক লম্বা সফরের অভিমুখ সূচিত করে।
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আবির বাগচীর প্রচ্ছদ বইটিকে নান্দনিক করে তুলেছে ।
------------------------------------------------------------
দেবদারু অপেরা – জয়শীলা গুহ বাগচী /এখন – বাংলা কবিতার কাগজ, জলপাইগুড়ি /প্রচ্ছদ-
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় , আবির বাগচী / মুল্য – ৫০ টাকা ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment