(পরিচালক বাক্ )
Monday, August 31, 2015
একজন কবির জীবনে প্রথম
কাব্যগ্রন্থ একবারই আসে। প্রথম প্রেম বা প্রথম চুমুর সঙ্গে তার তুলনা করার
রোমান্টিকতায় যাচ্ছিনা, কিন্তু, সম্ভবত, ওই বইটি একজন কবির জীবনে অনস্বীকার্য।
প্রথম চুমুর কথাই যদি বলেন, ওটা খুব দক্ষতার সঙ্গে খাওয়া যায়না, খেতে নেই, খাওয়া
চলেনা, তাহলে চুমুর অভ্যাসের ধারণা ও কলঙ্ক আপনাকে ধরে ফেলবে। প্রথম চুমুতে যদি
আপনার দুর্দান্ত নিপুনতা প্রকাশ পায়, চুম্বিত জন ধরে নেবেন, আপনি এর আগেও চুমু
খেয়েছেন, আপনি অভ্যস্ত, অথবা, আপনি কোনো ইরোটিক সিনেমার চুমুকে নকল করলেন। প্রেমিক
অথবা প্রেমিকা (আপনার রসিয়া পাঠক/ খাঁটি সমালোচক) তখন বরং ত্রস্ত হবেন, সন্দিগ্ধ
হবেন আপনার প্রতি। প্রথম বইটিতে খুব দক্ষতার ছাপ যদি থেকেই যায়, আপনি কবি না আপনি
পাঠক, সেই প্রশ্ন অনিবার্য। আর, সেই বই যদি আপনার তারুণ্যের হয়, তবে তো কথাই নেই।
কোন বয়সে কতটা পথ চলার পর আপনার বই বেরোল, সেটা তো দেখতেই হবে।
রমেন্দ্র কুমার আচার্য
চৌধুরীর মতো কৃপণ কবি এখানে উদাহরণ নন। স্বদেশ সেন নন। অনেক বয়সে অনেক ভেবে যারা
একটি এমনকি একটিমাত্র বই প্রকাশ করেন, তাঁরা অনেকেই নন।
যাই হোক, প্রথম বইটি
আপনি আপনার প্রথম বয়সেই প্রকাশ করলেন, আর আপনার মুক্তি নেই। আপনার কিন্তু বিচার
করা হবে। আপনি দক্ষ হলে যেমন বিপদ, আনাড়ি হলেও বিপদ। জীবনানন্দ দাশের জীবনে একটা ‘ঝরা পালক’
ছিল, ওই বইয়ের যাবতীয় নকলনবিশি তাঁকে ক্ষমা করেনি, সারাজীবন সঙ্গ ছাড়েনি।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘সঞ্চয়িতা’-র ভূমিকা লিখতে গিতে নিজের প্রথম ও প্রথমের দিকের
বইগুলোতে বড়োদের আসরে বালকসুলভ চাপল্যের ও স্খলিত চরণের কথা বলেছেন, একটা ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’
তাঁকেও শেষ অবধি অস্বস্তিতে রেখেছে, রেহাই দেয়নি। ভেবে দেখুন, রবীন্দ্রনাথের ওই
অস্বস্তির কারন ছিলনা। এক তরুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থের কাছে আমরা যা আশা করি, ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’
তা আমাদের মিটিয়েছে। ভাগ্যিস একটা ‘ঝরা
পালক’ রবীন্দ্রনাথের জীবনে
ছিলনা। প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথ অনেক খারাপ কবিতা লিখেছেন, সারাজীবনেই বহু খারাপ
কবিতা লিখেছেন, অ-কবিতা লিখেছেন, কিন্তু একটাও দক্ষ কবিতা লেখেননি। প্রথম জীবনেই বিহারীলালের
প্রভাব ছিল বটে, সারাজীবনই ছিল বৈষ্ণব কবিদের প্রভাব, ব্রিটিশ রোমান্টিকদের আদল,
মেটাফিজিকাল কবিদের ছাপ, কিন্তু তাতে তাঁর আন্তর্জাতিক নিজস্বতার কোনো সমস্যা
হয়নি। বাংলা কবিতার খাতটিকে অনুকরণের স্পৃহা যে তাঁর নেই, নিছক ভালো কবিতা তিনি
লিখতে আসেননি, লিখতে চাননা, পাঠককে অভ্যাসের বাইরে নিয়ে যেতে চান, অপর একটা
অভ্যাসের মধ্যে নিজের পাঠককে গড়ে নিতে চান, সেটা ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’
বুঝিয়ে দিয়েছিল, পায়রা কবির তকমাটাও জুটেছিল তাই।
রবীন্দ্রনাথ যে
রিস্কটা নিয়েছিলেন, জীবনানন্দ নেননি। নজরুলকে নকল করা বন্ধ করলেন বটে, কিন্তু
ইয়েটস আর পো এসে জুটলেন।
‘ঝরা পালক’
বই হিসেবে খারাপ হতে পারেনি। ‘ঝরা
পালক’ একটা ভালো কবিতার বই
ছিল। কিন্তু অন্য কিছুই তা ছিলনা। আন্তর্জাতিক পরিসরে, জীবনানন্দ দাশ সারা জীবনেও
একটা অন্য কবিতা লিখতে পারেননি কারন নিজের খারাপ কবিতার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল
ছিলেন না, একটাও খারাপ কবিতা জীবনানন্দ ছাপেননি, খারাপ কবিতা ছাপার সাহস তাঁর
ছিলনা।
মায়া আর ব্রহ্ম, এই
দুইয়ের ভেদে থাকা, বা এই দুইয়ের ভেদকে স্বীকার করা, এমনকি সেই ভেদ নিয়ে ভাবিত হওয়া
একজন কবির কাজ নয়। বাউল হোন, বা গৃহস্থ, একজন কবি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। নাহলে তিনি
সংসারী এক পোকা, নাহলে তিনি সর্বত্যাগী এক তপস্বী। শংকরাচার্যকে মাথায় তোলা কবির পক্ষে সম্ভব নয়। আবার
তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রয়োজনও কবির নেই। বিবেকানন্দও যে কবিতা লিখেছেন, কালীকে
নিয়ে লিখেছেন। অথচ তিনি ছিলেন বৈদান্তিক। শ্রী অরবিন্দ-র ‘সাবিত্রী’-র কথা ভাবা যাক। একজন কবি
যেমন নাস্তিক হতে পারেন না, হ্যাঁ তিনি নাস্তিক হতেই পারেন না, একজন কবি তপস্বী
হতেও পারেন না।
সেটা হলে রামকৃষ্ণের
চেয়ে মহৎ কোনো কবি আমাদের ভাষায় থাকতেন কি?
অনুপম মুখোপাধ্যায়
(পরিচালক বাক্ )
(পরিচালক বাক্ )
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
বলিষ্ঠ সম্পাদকীয়, চিন্তার ভিন্নতর ভঙ্গিটি ভালো লাগে। কবি মাত্রেই কবিতার কাছে পৌঁছোবার তাগিদ নিয়ে লিখতে বসেন, বিগত সময়কে অতিক্রম করার প্রয়াস। কবি ও পাঠক দুটো আসনে একই সাথে বসার চেষ্টা থাকে।
ReplyDelete